— কত বয়স হল?
প্রশ্নটায় কালীপদ একটু থতমত খেল। এই প্রশ্নটার উত্তর কালীপদ ঠিক জানে না।
–কত হবে? ওই ষাট, একষট্টি হবে।
ডাক্তার হাসল। ডাক্তার কালীপদকে চেনে— কালীপদর বয়স সত্তর থেকে বেশিই হবে, কম নয়।
–অত হবে? মুচকি হেসে বলল ডাক্তার। লো প্রেসার। একটু ভাল ভাল খাবার খান। রোজ দুটো করে ডিম খাবেন। মাঝে মাঝে মাংস খাবেন। গরু নেই?
কালীপদ দু’দিকে ঘাড় নাড়ল— অর্থাৎ নেই। পাগল! গরু দুধ দেবে কম, খাবে বেশি। পন পন খড়, ভুষি, খোল খাবে, কে জোগাবে ওসব?
–একটু দুধ খেতে হবে। ফল খান না, শীতের কমলালেবু, আপেল উঠছে, খেতে পারেন তো!
কালীপদর মুখভঙ্গি দেখে মনে হলো কালীপদ কোনও দুর্বোধ্য মন্ত্রোচ্চারণ শুনছে— এত সব খেতে হবে মানে জমানো টাকাটার মুড়িঘণ্ট হবে— সবাই কি ওর খুব টাকা দেখে, কী হবে তে সব খেয়ে! সেইতো সকালবেলায় মাঠের ধারে গিয়ে সব ফেলে আসতে হবে, গপগপ করে খেয়ে সব শেষ কর, তারপর বাকি জীবনটা ভিক্ষে করে বেড়াও আর কি!
–এই ট্যাবলেটটা সকালে একটা রাতে একটা খাওয়ার পরে। আর এটা দু’চামচ করে রাতে শোওয়ার আগে… ডাক্তার লিখতে লিখতে বলে চলল।
কালীপদ ডাক্তারের লেখাটা ঝুঁকে দেখল। লিখেই চলেছে ডাক্তার। ভীষণ রাগ হচ্ছে নাতনিটার ওপর। চেঁচামেচি করে দশজন লোক ডেকে ডাক্তার আনিয়ে কালীপদর ছাদ্দো করেছে।
–ওগুলোর দাম কত হবে? কালীপদর শরীরে বিদ্যুৎ খেলছে দুর্ভাবনায়।
— কোনগুলো?
— ওই, যা সব ছাইপাঁশ লিখেছ, কালীপদ মুখ কুঁচকে বলল।
–ছাইপাঁশ নয়, ওষুধ। পঞ্চাশ, ষাট টাকা লাগবে মনে হয়, আর আমার ভিজিট পঞ্চাশ টাকা।
— কত? কালীপদ আঁতকে উঠল।
— পঞ্চাশ টাকা।
— পন্-চাশ? অ্যাঁ? কালীপদর মনে হল বুকের ডানদিক, বাঁ দিক, তলপেট, মাথা সব যন্ত্রণা দিচ্ছে। একটুকরো ছেলে কাগজে ফসফস্ করে কী একটা লিখে পঞ্চাশ টাকা নিয়ে যাবে! এ তো দিনে ডাকাতি! এর আগে কি কালীপদর অসুখ হয়নি? ওষুধের দোকানে গিয়ে সমস্যাটা বলেছে— ওরা দু-চারটে ওষুধ দিয়ে দিয়েছে। ব্যাস, সুন্দর সেরে গিয়েছে। ওরা দাদু বলে সম্মান করে, কালীপদ যা দাম দেয় তাই নেয়— না হলে সুবল ডাক্তারের পুরিয়া আছে। দু’টাকা পুরিয়া আর দু’টাকা ডাক্তারের ফি। মোট চার টাকায় যে কোনও অসুখ সেরে যায়। কালীপদ বাবা-বাছা করে ওই দু’টাকায় করিয়ে নেয়। তা নয়, এই ভুঁইফোড় বাচ্চা ডাক্তারটাকে ডেকে এনে কী সর্বনাশ করেছে তার হতভাগী নাতনিটা।
— আমি দু’টাকা দিই বাবা। বুড়ো মানুষ আমি, রোজগারপাতি নেই, চার বছর হল আমার জোয়ান ছেলেটা আর ছেলের বউটা একসঙ্গে আন্ত্রিকে মারা গেছে গো।…কালীপদ কাঁদার চেষ্টা করে। মা-বাপ মরা এই মেয়েটাকে ভাল করে খেতে দিতে পারি না। ডিম, মাংস, দুধ এসব কী করে খাব– কালীপদ অনর্গল বলে যেতে থাকে…
ডাক্তার হেসে জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করে। কালীপদ সারসা গ্রামের নামকরা কৃপণ। ওর হাত দিয়ে যে ভিজিট আসবে না, তা জেনেই ঘর থেকে বেরিয়েছে ডাক্তার। কালীপর নাতনি তুলি ভেজা চোখ নিয়ে তাকে অনুরোধ করেছে। মেয়েটাকে ফেরাতে পারেনি ডাক্তার।
— থাক, আপনাকে আমায় টাকা দিতে হবে না। আমি হাসপাতালে চাকরি করি। অসুবিধে হলে ওখানে আসবেন, দেখে দেব, টাকা লাগবে না।
— তোমার নাম কী বাবা?
— অরিন্দম মুখার্জি। ডাক্তার বলে।
কালীপদ সুযোগ ছাড়ে না।– বাবা অরিন্দম, তোমার মঙ্গল হোক, হাজার হাজার টাকা রোজগার কর। অনেক বছর বেঁচে থাকো দাদু, ইত্যাদি বলে যেতে থাকে। এই কথাগুলোই কালীপদ বাসে উঠে কনডাক্টরকে বলে। বাসের কনডাক্টররা সবাই খুব সদয় হয় না কালীপদর ওপর। মাঝরাস্তায় নামিয়ে দেয় কালীপদকে। তা হোক, তবু তিন-চারমাইল তো এগিয়ে আসা যায়। মুশকিল হয় তুলি থাকলে, কিছুতেই বাস থেকে নামবে না, বলে, ‘দিয়ে দাও না, তোমার কাছে তো টাকা আছে।’ কালীপদ শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করে, ‘খুচরো নেই, একটা একশো টাকার নোট আছে রে বাবা’, তাতে বহুক্ষেত্রে কাজ হয়, কালীপদকে বাস থেকে নামতে হয় না। কনডাক্টর নিস্ফল গজগজ করতে থাকে।
ডাক্তার চলে যায়। যাওয়ার আগে তুলির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘সোয়াবিনের তরকারি করে দাদুকে খাওয়াও, কাজ হবে।’ তুলি লজ্জায় মাথা নীচু করেছিল। মাথা নীচু করেই ঘাড় নাড়ে। ডাক্তার চলে যেতেই তুলি ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘লজ্জা করে না তোমার। ডাক্তারকে দু’টাকা দিতে যাচ্ছিলে। ভিক্ষে দিচ্ছ নাকি। ভিরমি খেয়ে তো পড়েছিলে, তোমায় ওষুধ লিখে দিল, প্রেসার দেখল আর তুমি ডাক্তারকে টাকা দিলে না? কী হবে তোমার টাকায়, ব্যাঙ্কে পচবে আর তুমি পটল তুলবে।’
কালীপদ হাসার চেষ্টা করে। বলে, ‘তোর বিয়েতে লাগবে না? ডাক্তার মানুষটা বড় ভাল দেখলি।’
— ‘পয়সা না নিলেই ভাল’, রাগ করে তুলি অন্য ঘরে চলে যায়।
পঞ্চাশ টাকা না দেওয়ার তৃপ্তিতে কালীপদর শরীরটা ঝরঝরে লাগে। মনে মনে বলে— হুঁ ভারী ডাক্তার! ডিম খেতে হবে, ফল খেতে হবে, দুধ খান— এ সব তো যে কোনও লোকই বলতে পারে— এ কি নতুন কথা, ওষুধ দিল না, কাগজে অংবং লিখে গেল—ব্যাস! পঞ্চাশ টাকা দাও। মগের মুল্লুক। টাকা যেন গাছের ফল— নাড়া দিলেই পড়বে।
প্রেসক্রিপশনটা বিছানার উপর উড়ছে— কালীপদ ঘৃণার চোখে কাগজটার দিকে তাকায়— পঞ্চাশ, ষাট টাকা… বিড়বিড় করে কালীপদ।
–‘দাও টাকা দাও, ওষুধটা আনি’, তুলি বলে।
তুলির একটা তোলা জামা আছে, কালীপদ কালীপদ হাজার বার বলেছে, ভাল জামাটা যখন তখন পরিস না, ছিঁড়ে গেলে আর করে দিতে পারব না।
তুলি বলে—‘কেন,করে দিতে পারবে না কেন? আমার আরও দুটো জামা করে দিতে হবে।’
কালীপদর গা জ্বলে যায়— একটা হয় না, দুটো।
আজও মাথাটা দপ করে জ্বলে উঠল ওই জামাটা গায়ে দেওয়ার— আ মর, যাবি ওষুধের দোকানে, অত সাজবার কী আছে! মুখে বলে, ‘আমার পয়সা নেই, ওষুধ আনতে হবে না।’
–‘হবে না তো?’ তুলি কোমরে হাত দিয়ে বলে।
— ‘জামাটা আলমারি থেকে বার করলি কেন শুনি? ওষুধের দোকানে যাচ্ছিস না বিয়ে বাড়ি যাচিা্ছস? জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দেব—ঢলানি কোথাকার।’ কালীপদ আসল জ্বালাটা বার করে দেয়।
খানিকক্ষণ কেঁদে নেয় তুলি। তারপর ফটোফ্রেমের মধ্যে বাবা-মা’র হাসিহাসি মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তুলি যখন দুঃখ পায় তখনও বাবা-মার মুখের একইহাসি অবিচল থাকে দেখে তুলির দুঃখবোধ যেন বেড়ে যায়। তখন আর বাবা-মার ছবির দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না তুলির।
এইমাত্র যে মানুষটার জন্য কাঁদতে কাঁদতে ডাক্তার ডেকে এনেছিল তার এমন হতকুচ্ছিৎ ব্যবহার দেখে তুলির চোখ ভর্তি জল আসে। জামাটা দু’বছরের পুরনো— প্রথম বছর পরতে দেয়নি বড় হচ্ছে বলে, আগের বছর হাতে গোনা কয়েকটা দিন পরেছে, আর এখন জামাটা ছোট হচ্ছে— তবুও পরতে দেবে না। ধীর পায়ে তুলি অন্য ঘরে চলে যায়।
অন্য ঘরটা তুলির। আগে এটা একটা লম্বা বারান্দা ছিল। এখন একটা আলকাতরা মাখা দরজা আর একটা জানলা দিয়ে এটাকে ঘরের রূপ দেওয়া হয়েছে।
এই ছোট্ট জানলা দিয়ে অনেক বড় আকাশ দেখা যায়। সীমাহীন ক্ষেত, মাঝখান দিয়ে লাল মোরামের পথ, ক্ষেতের মাঝে মাঝে খেজুর গাছ আর দিগন্ত জুড়ে ঘন ছায়া আর সবুজে মেশা বিভিন্ন গাছপালা। দুঃখ পেলে তুলি দরজা বন্ধ করে হতশ্রী বিছানার ওপর উপুড় হয়ে কিছুক্ষণ কাঁদে। ভীষণ অভিমান হয় বাবা-মা’র জন্য—তারপর জানলা দিয়ে অসীম শূন্যতার দিকে তাকাতে তাকাতে মনটার ভার কী করে যেন লাঘব হতে থাকে।
বাইরের দিকে তাকালেই তুলি অনেক দিবাস্বপ্ন দেখতে পারে। সুন্দর একটা স্কুল ব্যাগ নিয়ে ও স্কুলে যাচ্ছে। ওর সব বন্ধুরা ওকে দেখছে। নতুন স্কুলের ড্রেস, নতুন জুতো। তুলি, তোকে দারুণ লাগছে, তোকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে তুলি— সবাই বলছে। একটা স্কুল ব্যাগ কবে থেকে দাদুকে কিনে দিতে বলেছে তুলি। স্কুলের ড্রেস ছিঁড়ে গেছে, বিশ্রীভাবে হাঁটুর অনেক উপরে উঠে এসেছে। এই নিয়ে অনেক কেঁদেছে তুলি। জুতোর বদলে ছেঁড়া চটি। এমন অনেক না-পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তুলির স্বপ্নের তালিকাও বড় হতে চলেছে।
খানিকক্ষণ কেঁদে নেয় তুলি। তারপর ফটোফ্রেমের মধ্যে বাবা-মা’র হাসিহাসি মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তুলি যখন দুঃখ পায় তখনও বাবা-মার মুখের একইহাসি অবিচল থাকে দেখে তুলির দুঃখবোধ যেন বেড়ে যায়। তখন আর বাবা-মার ছবির দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না তুলির। শীতের ঠান্ডা হাওয়া মাঠের বুকে শব্দ করে চলে যাচ্ছে— কেমন এক মনখারাপ করা হাওয়া। তুলি জানলা দিয়ে দেখে লাল মোরামের রাস্তা ধরে ডাক্তার এই দিকে আসছে। তুলি জানলার কাছে চলে আসে। তারপর এক অজ্ঞাত লজ্জায় আবার ভেতরের দিকে ঢুকে আসে। ডাক্তার জানলার দিকে হেসে তাকিয়েছে। তুলির ইচ্ছে হয় এখনই ওর জ্বর হোক— খুব জ্বর, ডাক্তার তাই শুনে একবার দেখতে আসুক তুলিকে। তুলির গরম কপালে তার হাতটা দিয়ে বলুক— সেরে যাবে।
চার-পাঁচটা স্বাস্থ্যবান টনিকের বোতলের মাঝখানে একটা ফাঁকা জায়গায় গণেশ ঠাকুর বসে আছেন। টনিক না খেয়েও গণেশ ঠাকুরের স্বাস্থ্য বেশ ভাল। খোকন তার উদ্দেশে রোজ দুটো ধূপকাঠি বরাদ্দ করেছে। একটা সকালে আর একটা সন্ধ্যায়। বিকেলের আলো প্রায় নেই। স্যালাইনের একটা ফাঁকা বোতল থেকে খোকন গঙ্গাজল ছেটায়। কাছেপিঠে গঙ্গা নেই বলে খোকন গঙ্গার জল তৈরি করে রাখে। তিন-চার বছর আগে খোকন একবার দক্ষিণেশ্বরে এসেছিল— তখন একতাল গঙ্গার মাটি নিয়ে ফিরেছিল। তারই একটুখানি ময়ূরাক্ষীর জলের সঙ্গে মিশিয়ে বিশুদ্ধ গঙ্গাজল তৈরি করে খোকন। গঙ্গার জল ছিটিয়ে খোকন ধূপকাঠি জ্বালানোর উদ্যোগ নেয়। ধূপকাঠি জ্বালিয়ে গণেশ ঠাকুরকে দেখানোর সময় খোকন তীব্র মনঃসংযোগ করে— গণেশকে ধূপ দেখিয়ে ধারের খাতাটার ওপর ধূপটাকে একবার ঘুরিয়ে নেয়। কালীপদ সেই সম্যয় দোকানে ঢোকে। কালীপদকে দেখে খোকনের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়— গত ছ’মাস ধরে কালীপদর ধারটা বেড়েই চলেছে। দু’টাকা দেয় তো পাঁচ টাকার ওষুধ নেয়। এই করে ধারের পরিমাণটা একশো সাতান্ন টাকা কিছু পয়সা হয়েছে। পয়সাটা কত খোকন মনে করার চেষ্টা করে।
–‘আর বোলো না বাবা, কী যে হলো আজ, মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম বাড়ির উঠোনে— তা সে ডাক্তার বদ্যি ডেকে ওই যে বাবা তোমাদের অরিন্দম ডাক্তার— ভারী ভাল ছেলে— বললে, ছি ছি আমায় টাকা দেবেন কেন, এ তো আমার কর্তব্য। কিছুতে টাকা নিলে না…’ কালীপদ বলে যেতে থাকে।
খোকন ধারের খাতাটা খোলে।
–‘একশো সাতান্ন টাকা আশি পয়সা হয়েছে দাদু।’
কালীপদ সামনের রাখা টুলে বসে পড়ে। খোকনের কথাটা এড়িয়ে বলতে থাকে—‘মাথাটা এখনও ঘুরছে বাবা বুঝলে। ডাক্তার বলেছে মাছ, মাংস, দুধ, ঘি, আপেল, কমলালেবু খেতে হবে। বলো—‘আমি গরিব মানুষ, কোথা থেকে পাব, এই তোমার কাছেই কত টাকা হয়ে গেল— দিতে পারছি? তুমি আমায় কোনওদিন লজ্জা দিয়েছ? কোনওদিন না!’
খোকন ধারের খাতাটা বন্ধ করে।
কালীপদ ফতুয়ার পকেট থেকে সোঁদা কাগজটা বের করে বলে, ‘দেখ তো বাবা, ওষুধগুলো আছে কিনা। না থাকলে যা হোক একটা কিছু দাও তো, তুমি তো বেশ ভাল ওষুধ দাও, মুখপোড়া তুলিটা ডাক্তার ডেকে এনে এমন কাণ্ড করলে…’ কালীপদর কাগজটা খোকন নেয় না, অন্য কাজ খুঁজতে থাকে। বলে,
–‘আগের ধারটা শোধ না হলে ওষুধ দেওয়া যাবে না দাদু, তাছাড়া এখনই দোকান খুললাম, ধূপ দিলাম…’
–‘ধূপের গন্ধটা ভাল, কী ধূপ?’ কালীপদ কথা ঘোরায়।
–‘কী হবে টাকা জমিয়ে দাদু, আর দু’দিন বাদে তো ফুটে যাবেন। সব নাতনি আর নাত-জামাই তো পাবে, কী?’ খোকন তির্যকভাবে বলে।
–‘হুঁ, কালীপদ বিরক্তিসূচক ধ্বনি দেয়।
ইতিমধ্যে কয়েকজন খদ্দের পেয়ে যায় খোকন। কালীপদ আধঘণ্টা সাদা কাগজটা নিয়ে বসে থাকে। খোকন একজনের পর একজনকে ওষুধ দিতে থাকে। একসময় কালীপদ উঠে পড়ে। আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে ফতুয়ার আর এক পকেট থেকে বিবর্ণ একটা দু’টাকা বের করে বলে— ‘নাও বাবা, দু’টাকা দিলাম, ধারটা একটু কমুক।’
খোকন দু’টাকা না নিয়ে হাসে। বলে—‘রেখে দিন দাদু, কালকের বাজারটা হয়ে যাবে, দিন দেখি প্রেসক্রিপশনটা।’
কালীপদ দু’টাকাটা আবার যথাস্থানে রাখতে রাখতে ভাবে, দু’টাকাটা ভারী কাজের দেখছি, কেউই নিতে চাইছে না অথচ কাজ হচ্ছে।
–‘কুড়ি টাকা আশি পয়সা হল–এটাতেই। পাঁচদিনের ওষুধ দিলাম।’
–‘যা দিয়েছ তাতেই হবে’, কালীপদ গদগদ হয়ে বলে, ‘বেঁচে থাকো বাবা, তোমার লাখ লাখ টাকা হোক। ধানটা উঠলেই তোমার পাই পয়সা চুকিয়ে দেব।’
ধারের খাতায় নতুন ধারটা লিখে খোকন বলে, ‘একশো আটাত্তর টাকা ষাট পয়সা হলো।’
কালীপদ যেতে যেতে বলে, ‘ধরে নাও একশো আশি টাকা।‘
–‘এ কে? আপনার নাতনি?’ চশমার ফাঁক দিয়ে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার প্রশ্ন করে।
–‘হ্যাঁ’, কালীপদ উত্তর দেয়।
— ‘কী নাম তোমার?’ ম্যানেজার তুলির দিকে চোখ রেখে বলে।
— ‘তুলিকা ভট্টাচার্য, সবাই তুলি বলে’, তুলি উত্তর দেয়।
কালীপদ গ্রাম থেকে শুনেছিল নতুন ম্যানেজার এসেছে, একেবারে বাচ্চা ছেলে, ব্রাহ্মণ। ব্যাঙ্কে এসে মেজাজটা বিগড়ে গেছে, বাচ্চা কোথায়? চল্লিশের ওপর বয়স তো হবেই। অমর চক্রবর্তী গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ব্যাঙ্কের ব্যবসা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ম্যানেজারের কানে কানে ব্যাঙ্কের পুরনো কর্মী দিবাকর বলে যায়, ‘প্রচুর টাকা বুড়োর। সেভিংসেই দু’লাখ টাকা পড়ে আছে, ফিক্সড আছে প্রায় দশ লাখ। শুধু জমায়, টাকা তোলে না, চাপ দিলে আরও টাকা জমা দেবে।’ অমর মাথা নাড়ায়।
— ‘ওর বাবা, মা একদিনে মারা গেছেন, আন্ত্রিকে’– দিবাকর বলে। অমর ব্যথিত চোখে তুলির দিকে তাকিয়ে থাকে।
কালীপদর হয়ে দিবাকর জমার রসিদ ভর্তি করে। লক্ষ্মীর প্রতি কালীপদর যেমন দরদ, সরস্বতীর প্রতি তেমনই অনীহা। নিজের নামটা কালীপদ কোনওক্রমে সই করতে পারে। পাসবইটা ঠিকঠাক করে নেয় কালীপদ। ইতিমধ্যে তুলিকে অনেক জায়গায় সই করতে হয়। ম্যানেজারকে প্রশ্ন করে তুলি—‘এত সই করছি কেন?’
— ‘তোমার দাদুর তুমিই তো সব’, অমর বলে।
তুলির জন্য কালীপদ মনে মনে পাত্র খুঁজছে। অল্প বয়সের ছেলে আর ব্রাহ্মণ হলেই হবে। একটা অল্পবয়সি নাতজামাই তার দরকার। তার চাষের কাজে সাহায্য করবে, ব্যাঙ্কে, ট্রেজারিতে দৌড়োদৌড়ি করবে। তাহলে কালীপদ জমিয়ে একটা ব্যবসা করে। ধান থেকে চাল করবে। সারা গ্রামের ধান কিনে নেবে, ব্যবসাটা একটু দাঁড়ালে চারপাশের সব গ্রামের ধান কিনে নেবে— একটা চালকল করবে। ধান থেকে চাল, চাল থেকে টাকা, টাকা থেকে ধান আবার চাল আবার টাকা, কালীপদ ইদানীং রাস্তায় যেতে যেতে তার বিরাট ব্যবসাটা পুরো দেখতে পায়, বিড়বিড় করে। কিন্তু অসুবিধা হয়ে গেল ছেলেটা মরে গিয়ে। সবে টাকার মুখ দেখতে শুরু করেছিল কালীপদ— আর হঠাৎ তিন-চার দিনের আন্ত্রিকে ছেলে, ছেলের বউ চলে গেল। ছেলের অনেকগুলো টাকা আটকে আছে ট্রেজারিতে— কালীপদ প্রত্যেক পনেরোদিন অন্তর কান্নাকাটি করে— কিন্তু তেমন কাজ হচ্ছে না। এফিডেভিট কর, সিওরিটি আনো, ডেথ সার্টিফিকেটে ভুল আছে— ঠিক করে নিয়ে এসো, কত কী চাই। আর এই প্রত্যেকটা চাওয়া মেটাতে উকিল পয়সা নিচ্ছে, ডাক্তার পয়সা নিচ্ছে…কালীপদ একেবারে পথে বসে পড়েছে।
–‘বেশ নামটা তোমার। তুলিকা। রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়?’ অমর চক্রবর্তী কাজ করতে করতে তুলিকে প্রশ্ন করে।
–‘হ্যাঁ, আমার কাছে সঞ্চয়িতা আছে’, তুলি বলে।
–‘বা! তুলিকা তুমি বলাকা পড়েছ?’ অমর তুলির মুখের দিকে তাকায়।
— ‘বলাকা?’ তুলি মনে করার চেষ্টা করে।
— ‘হুঁ, সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা… পড়েছ?’
— ‘না বোধ হয়, আফ্রিকা পড়েছি, উদভ্রান্ত সেই আদিম যুগে…’
— ‘স্রষ্টা যখন নিজের প্রতি অসন্তোষে…’
— ‘আপনার মুখস্ত?’ তুলি প্রশ্ন করে।
–‘আগে মুখস্ত ছিল, আবৃত্তি করতাম’ অমর হাসে।
কালীপদ সেই সময় কোঁচড় থেকে দু’হাজার টাকা বের করে গুনতে শুরু করেছে। কালীপদর সবচেয়ে ভাল লাগে টাকা গোনা। নতুন টাকার গন্ধ কালীপদর খুব প্রিয়।
— ‘দাদু কত টাকা দিচ্ছেন?’ অমর প্রশ্ন করে।
— ‘দুই দিলাম।’ কালীপদ উত্তর দেয়।
— ‘আমি ‘প্রশ্ন’ জানি। ভগবান তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে…’
— ‘দয়াহীন সংসারে’ অমর খেই ধরে।
— ‘রবীন্দ্রনাথের সব কবিতা আপনার মুখস্ত? তুলি অবাক হয়ে বলে।
— ‘না, না’, অমর জোরে হেসে ওঠে, ‘প্রশ্ন’ তোমার মুখস্ত?
— ‘সবটা, আমি প্রাইজ পেয়েছিলাম এটা আবৃত্তি করে।’ তুলি মুখ উজ্জ্বল করে বলে।
— ‘দাদু আরও একটু জমান। আমাদের ইন্টারেস্ট বেড়েছে’ কালীপদর উদ্দেশে অমর বলে।
— ‘জমাতে জমাতে যমে নিয়ে যাবে’, তুলি হঠাৎ বলে। কালীপদ টাকা গোনায় মশগুল, শুনতে পায় না।
— ‘তোমার টাকা জমাতে ভালো লাগে না?’ অমর অবাক হয়ে তুলিকে প্রশ্ন করে।
— ‘না, জমিয়ে কী হয়? জমিয়ে লাভ কী যদি খরচ না করতে পারি?’ তুলির কণ্ঠস্বরে বিরক্তি।
— ‘তোমার বাবা কী করেন?’
— ‘বাবা নেই’, তুলি মাথা নিচু করে।
— ‘ওর বাবা, মা একদিনে মারা গেছেন, আন্ত্রিকে’– দিবাকর বলে। অমর ব্যথিত চোখে তুলির দিকে তাকিয়ে থাকে।
কালীপদর হয়ে দিবাকর জমার রসিদ ভর্তি করে। লক্ষ্মীর প্রতি কালীপদর যেমন দরদ, সরস্বতীর প্রতি তেমনই অনীহা। নিজের নামটা কালীপদ কোনওক্রমে সই করতে পারে। পাসবইটা ঠিকঠাক করে নেয় কালীপদ। ইতিমধ্যে তুলিকে অনেক জায়গায় সই করতে হয়। ম্যানেজারকে প্রশ্ন করে তুলি—‘এত সই করছি কেন?’
— ‘তোমার দাদুর তুমিই তো সব’, অমর বলে।
— ‘চল রে তুলি, এখনই বাস আসবে’, কালীপদ বলে।
— ‘বড় হয়ে তুমি কী করবে তুলি?’ অমর প্রশ্ন করে।
— ‘বেশি জমাব না, খরচ করব। ডাক্তার হব।‘
— ‘ডাক্তার হবে কেন?’
— ‘ডাক্তার আমার ভাল লাগে’, তুলিও লাজুক কণ্ঠে বলে।
— ‘ওর সঙ্গে একটা ডাক্তারের বিয়ে দেবেন দাদু’, অমর বলে।
ম্যানেজারের রসিকতায় কালীপদ চেষ্টা করে হাসতে। অনেকদিন না হেসে কালীপদর হাসার অভ্যাসটা নষ্ট হয়ে গেছে।
— ‘আমায় অতগুলো সই করালে কেন?’ বাসে উঠে তুলি বলে।
— ‘আমি মরে গেলে সব টাকা তো তুই পাবি।’ কালীপদ ফিসফিস করে।
— ‘আর আমি মরে গেলে?’ তুলি হাসে।
কালীপদ চমকে তাকায় তুলির দিকে। এ কথাটা কালীপদ কোনওদিন ভাবেনি কেন? ছেলে, ছেলের বউ তো একদিনেই মরে গেল।
— ‘দাদু, টিকিট’, কনডাক্টর খরখরে গলায় হাঁক মারে।
— ‘এটা কি অর্জুনের বাস?’ কালীপদ কনডাক্টরকে বলে।
— ‘না, টিকিট দিন’, কন্ডাক্টরের কোনও রসকস নেই।
কালীপদ ফতুয়ার ডান পকেট থেকে পয়মন্ত সেই দু’টাকাটা বের করে এগিয়ে দেয়—‘এই নাও বাবা, আর নেই।’
— ‘এ বাসটা তেলে চলে দাদু, জলে নয়। তেলের দাম বেড়েছে, দু’জনের টিকিট ছ’টাকা লাগবে।’
— ‘কীসের ছ’টাকা? দুবরাজপুরে উঠেছি।’
— ‘হ্যাঁ, সারসা যাবেন তো, ছ’টাকা লাগবে দু’জনের।’
কনডাক্টর গেটের পাশে ফাটা টিনে চড় মারে, বাস থেমে যায়।
— ‘কই নামুন?’
— ‘আয় তুলি, দাও দু’টাকাটা দাও দেখি— আমি রোজ যাই, হঠাৎ ছ’টাকা বললেই হল’– কালীপদ ঝগড়া শুরু করে।
— ‘দু’টাকা দেব কেন দাদু, এতটা পথ এলেন এমনি এমনি, রোজ বাসে উঠে ঝামেলা করবেন, পয়সা বের করতে এত কষ্ট তো পায়ে হেঁটে যেতেই পারেন’, কনডাক্টর গলা চড়াতে থাকে, ‘দুবরাজপুর থেকে সারসা যাবেন মাথা পিছু একটাকা দিয়ে, ভিক্ষে দিচ্ছেন নাকি?’
— ‘তুমি দাও দেখি দু’টাকাটা– এখনও পাঁচড়া আসেনি, তুমি আমায় নামিয়ে দিচ্ছ– তুমি ভিখিরি ছাড়া আর কী?’
— ‘এই নিন আপনার দু’টাকা— এ টাকাটা রাস্তায় ফেলে দিলেও কেউ নেবে না।’
চোখ বড় বড় করে তুলি দাদুর সঙ্গে নেমে যায়। অপমানে ওর ঠোঁট দুটো কাঁপছে— গলা ভর্তি কান্না, মনে হচ্ছে চিৎকার করে ও কেঁদে ফেলবে।
কনডাক্টর রাস্তার ওপর দু’টাকা মুচড়ে ফেলে দিয়ে কালীপদর উদ্দেশে একটা গালাগাল ছোঁড়ে।
কালীপদ চিৎকার করে ওঠে—‘হেই হারামজাদা, কী বললি আমায়?’ বাস ততক্ষণে এগিয়ে গিয়েছে। কালীপদ বাসের উদ্দেশে একটু দৌড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। মাথাটা দপদপ করছে কালীপদর। তুলি রাস্তা থেকে মোচড়ানো দু’টাকা তুলে কালীপদর সামনে ছিঁড়ে ফেলে।
–তুই ছিঁড়ে ফেললি টাকাটা?’ কালীপদ চিত্কার করে ওঠে।
— ‘বেশ করেছি, হয় তুমি মর, তোমার টাকা আমি পাই, নয় আমি মরি তোমার খরচ কমুক’, কেঁদে ফেলে তুলি।
কালীপদ এক চড় বসিয়ে দেয়—‘মর, মরে যা তুই।’
কমলালেবু, আপেল, খেজুর বিক্রি করছে একটা লোক—তুলি কাছে যেতেই লোকটা ষাঁড় তাড়ানোর মতো বলে—‘যাও, যাও এখান থেকে।’ তুলি ফুঁপিয়ে ওঠে, ‘কমলালেবু কিনব, আপেল কিনব…’ তুলি জ্বরে ভুল বকছে। কালীপদ সেদিন চিৎকার করেই লোক জড়ো করেছিল। ব্লকের জিপটা সৌভাগ্যবশত সে রাস্তায় আসছিল। কালীপদ একরকম আর্তনাদ করে গাড়িটাকে থামিয়েছে। বাড়ি এসেই কালীপদ ছুটে গেছে ডাক্তারের কাছে। তুলির জ্ঞান ফিরেছে তবু সঠিকভাবে ফেরেনি। অন্ধকারের মধ্যে তুলি সাঁতরে চলেছে উদ্দেশ্যহীন।
তুলি কাঁদে। মাথায় রোদ, চারপাশের শনশন হাওয়া, পথের থেকে লাল ধুলো উড়ছে। তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে অপমানে, অভিমানে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে তুলি।
কালীপদ হাঁটতে থাকে। তুলি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকে।
— ‘এলি তুই?’ কালীপদ হাঁক মারে। তুলি পথের মাঝখানে বসে পড়ে। কালীপদ আবার হাঁটতে থাকে। তুলি পথের ওপর শুয়ে পড়ে। কালীপদ ব্যাপার দেখে পিছনে ফিরতে থাকে।
— ‘কী হলো তোর? কী হলো রে?’ গায়ে হাত দিতে তুলি এলিয়ে পড়ে। তুলি জ্ঞান হারিয়েছে।
চিৎকার করে ওঠে কালীপদ—‘কে কোথায় আছ? মেয়েটা মরে যাচ্ছে, বাঁচাও ওকে।’
কালীপদ শুনতে পায়, দূরে ইউক্যালিপটাস জঙ্গল থেকে প্রতিধ্বনি ফিরে আসছে, বাঁচাও ওকে।
কালীপদ কেঁদে ফেলে, তুলিকে ঝাঁকায়, ‘তুলি, তুলি আমার।’
— ‘বলাকা পড়েছ? সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা…’ তুলি স্পষ্ট দেখতে পায় ম্যানেজারবাবু ওর দিকে তাকিয়ে হাসছেন।
— দু’টাকায় দুবরাজপুর থেকে সারসা, কনডাক্টর একটা লাঠি হাতে দাদুকে তাড়া করেছে।
তুলি সভয়ে চিৎকার করে ওঠে—‘দিয়ে দাও, টাকাটা দিয়ে দাও।’
কমলালেবু, আপেল, খেজুর বিক্রি করছে একটা লোক—তুলি কাছে যেতেই লোকটা ষাঁড় তাড়ানোর মতো বলে—‘যাও, যাও এখান থেকে।’ তুলি ফুঁপিয়ে ওঠে, ‘কমলালেবু কিনব, আপেল কিনব…’ তুলি জ্বরে ভুল বকছে। কালীপদ সেদিন চিৎকার করেই লোক জড়ো করেছিল। ব্লকের জিপটা সৌভাগ্যবশত সে রাস্তায় আসছিল। কালীপদ একরকম আর্তনাদ করে গাড়িটাকে থামিয়েছে। বাড়ি এসেই কালীপদ ছুটে গেছে ডাক্তারের কাছে। তুলির জ্ঞান ফিরেছে তবু সঠিকভাবে ফেরেনি। অন্ধকারের মধ্যে তুলি সাঁতরে চলেছে উদ্দেশ্যহীন।
–‘আমি তোমাকে পঞ্চাশ টাকাই দেব ডাক্তার, ওকে সারিয়ে দাও।’
ডাক্তার একটা ইঞ্জেকশন দেয় তুলিকে। কঠিন চোখে তাকায় কালীপদর দিকে—‘টাকা ছাড়াও পৃথিবীতে অনেক ভালো জিনিস আছে দাদু। মেয়েটাকে প্রায় মেরে ফেলেছেন তো।’
— ‘ও সেরে যাবে তো?’ কালীপদ দু’হাত জোড় করে।
— ‘গায়ে তো একটুও রক্ত নেই ওর। ভীষণ অ্যানিমিয়া। আপনার শরীরে মায়া দয়া নেই কেন?’ অরিন্দম নিজের জিনিসপত্র গোছাতে থাকে।
— ‘ওষুধ দিলে না?’ কালীপদ কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে।
— ‘খাবার দিন, ভাল খাবার দিন। ওষুধ আমি পাঠিয়ে দেব। ও এখন ঘুমোবে— কাল থেকে ওকে একটু আনন্দ দিন, ও শক্ পেয়েছে’
অরিন্দমের পেছনে ছুটে কালীপদ পঞ্চাশ টাকা ধরিয়ে দেয়।
— ‘থাক’, অরিন্দম বলে।
— ‘না, দাদুভাই তুমি নাও, আমার আছে।’
অরিন্দম অবাক হয়ে টাকাটা নেয় আর বলে, ‘কিছুক্ষণ বাদেই আমি এ পথ দিয়ে যাব তখন দু’রকম ট্যাবলেট দিয়ে যাব, নিয়ম করে খাওয়াবেন।’
— ‘অবশ্যই খাওয়াব’, কালীপদ মাথা নিচু করে।
তুলি ঘুমোচ্ছে— গাঢ় ঘুম। কালীপদ ইতিমধ্যে ওর মাথায় অনেকবার হাত বুলিয়ে দিযেছে। তুলি একবার গভীর ঘুম থেকে কাতর চোখ মেলে বলেছে, ‘বলাকা’। কালীপদ তুলির নরম ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে আবিষ্কার করে এই ছোট্ট মেয়েটার ইচ্ছে, আনন্দ, সুখের ব্যাপারে সে ভীষণ উদাসীন।
তুলির মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কালীপদর ভয় হতে থাকে— এই মেয়েটাও হঠাৎ ওকে ফাঁকি দেবে না তো! ‘মেয়েটাকে প্রায় মেরে ফেলেছেন তো’— ডাক্তারের কথাটা বুকের মধ্যে হাহাকার তৈরি করছে, করেছে কী কালীপদ— এত নিষ্ঠুর কী করে হতে পারল! তুলির কানের কাছে মুখ নিয়ে কালীপদ ডাকে, ‘তুলি, তুলি ভাই’। তুলি উত্তর দেয় না। শুধুএক গভীর উষ্ণ নিশ্বাস পড়ে।
বাড়ির বাইরে এসে কালীপদ হাঁক মারে, ‘বৌমা, বৌমা একটু আসবে?’
প্রতিবেশী এক মহিলা বেরিয়ে এসে বলে—‘কী হয়েছে কাকা?’
কালীপদ ব্যস্ততার সঙ্গে বলে, ‘তুলির খুব জ্বর, ভুল বকছিল। ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে— এখন ঘুমোচ্ছে। একটু খেয়াল রাখবে মা— আমি একটু দুবরাজপুর যাব আর আসব।’
মহিলা ব্যস্ত হয়ে ওঠে। তুলি এ অঞ্চলে সবার প্রিয়। তাড়াতাড়ি বাড়িতে ঢুকে বলে, ‘সে কী, কখন হলো এসব? কবে থেকে জ্বর?’
— ‘কাল বিকেল থেকে, রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। আমি যাব আর আসব, তুমি তুলিকে একটু খেয়াল রেখো বৌমা।’ কালীপদ কথা বলে আর দাঁড়ায় না। বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে— এখনই দুবরাজপুর যেতে হবে। বাসে ওঠার আগে একটা শক্ত হাত কালীপদকে আটকে দেয়। কালীপদ মুখ তুলে দেখে, সেই দিনের সেই কনডাক্টার, যে দু’টাকা রাস্তায় মুচড়ে ফেলে দিয়েছিল।
কালীপদ কঠিন চোখ করে বলে—‘আমার নাতনির বড় অসুখ, আমাকে উঠতে দাও, দুবরাজপুর যাব।’
— ‘ভাড়া আছে তো?’ ছেলেটা বলে।
— ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আছে দেব। তিন টাকাই দেব।’ কালীপদ জোর গলায় বলে ওঠে।
কনডাক্টর ছেলেটা কালীপদকে পথ ছেড়ে বলে, ‘এই তো ভাল মানুষের মতো কথা দাদু।’
কালীপদ সে কথায় কান না দিয়ে বাসে ওঠে। দুপুরের বাস, লোকজন কম। কালীপদ বসার জায়গা পেয়ে যায়।
— ‘কটন মিল কে নামবে?’ কনডাক্টর হাঁকে। কেউ নামে না। কনডাক্টর বাসের ফাটা টিনে মেরে হাঁকে, ‘হেই’। বাস আবার চলতে থাকে। চারপাশ শূন্য। আজ দুপুরের রোদের তেজ তেমন নেই। একটা পাগলা হাওয়া বাসের ভেতর হুটোপুটি করতে থাকে। কালীপদ পাশে বসা এক অল্পবয়েসি ছেলের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কত বাজল বাবা?’
— ‘দুটো দশ’, ছেলেটা বলে।
— ‘ব্যাঙ্কের টাকা জমা নেওয়া ক’টায় বন্ধ হয়?’ কালীপদ প্রশ্ন করে ছেলেটাকে।
— ‘দু’টোতে’, ছেলেটা বলে।
কালীপদ অস্থির হয়েছ ওঠে।
দুবরাজপুরে পোদ্দার বাঁধে গাড়ি দাঁড়িয়ে যায়। সামনে একটা লরি দেহ রেখেছে। রাস্তা গেছে আটকে। কালীপদ তাড়াতাড়ি ভাড়া দিয়ে নেমে পড়ে। খানিকটা এগোলেই ব্যাঙ্ক। কালীপদকে আজ ব্যাঙ্কে যেতেই হবে।
মিনিট দশেক হেঁটে কালীপদ ব্যাঙ্কে পৌঁছয়। ব্যাঙ্কে ঢোকার আগে কালীপদ একজনকে প্রশ্ন করে—
‘ক’টা বাজল?’
লোকটা শুনতে পায় না। কালীপদ দাঁড়ায় না, ব্যাঙ্কে ঢুকেই বলে—‘আমার একটু দেরি হয়ে গেল।’
— ‘আজকে আর কিছু হবে না দাদু’, ব্যাঙ্কের দপ্তরি স্বপন বলে।
— ‘হবে না মানে?’ কালীপদ চিৎকার করে ওঠে?
তাড়াতাড়ি ম্যানেজার এগিয়ে আসে, ‘নিশ্চয়ই হবে। কত জমা দেবেন?’
— ‘জমা দেব না, তুলব, পাঁচ হাজার টাকা’, হাঁপাতে থাকে কালীপদ।
‘সে কী দাদু, রাগ করেছেন নাকি!’ অমর হাসিমুখে বলে।
— ‘না, না, রাগ করব কেন? আমায় একটু তাড়াতাড়ি ছেড়ে দাও। আমার নাতনির অসুখ।’
— ‘কী হয়েছে তুলিকার?’ অমর এগিয়ে আসে।
— রক্ত কম, খুব কম, ওকে আমি ভাল করে খেতে দিইনি, ওকে আমি প্রায় মেরে ফেলেছি।’ চোখের ভেতর জ্বালা করে কালীপদর।
ব্যাঙ্কের কাজ দু’মিনিটে মিটে যায়। কুড়ি বছর ধরে কালীপদ শুধুই জমিয়েছে। এই প্রথম তার টাকা তোলা। এই প্রথম কালীপদ টাকা না গুণেই পকেটে ভরে নেয়।
— ‘দাদু টাকা গুনে নিন’, দিবাকর বলে।
— ‘ঠিক আছে’, বলেই কালীপদ ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসে। টাকার মূল্য কালীপদর কাছে অকস্মাৎ কমে গিয়েছে।
শীতের হাওয়া দিচ্ছে। কালীপদ জানলার ধারে বসে। অন্ধকারে ডুবে থাকা গ্রাম দেখতে দেখতে সেই হাওয়ায় নিজেকে হালকা করতে থাকে।
‘টাকা ছাড়াও পৃথিবীতে অনেক ভাল জিনিস আছে দাদু’— ছোকরা ডাক্তারটা তাকে বেশ কথা বলেছে। ডাক্তারের ঠোঁটচাপা হাসি আর তুলির লজ্জিত মুখ চোখ বুজলেই কালীপদ দেখতে পাচ্ছি।
— ‘সারসা’, কনডাক্টর হাঁকে।
— ‘নামব, নামব, দাঁড়াও‘’ কালীপদ উঠে পড়ে।
— ‘বসেছিলেন কেন? এগিয়ে আসবেন তো?’ কনডাক্টর বিরক্তিতে বলে।
কালীপদর হাতে অনেক প্যাকেট— একরকম টলতে টলতে কালীপদ নামে।
— ‘ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন দাদু?’ বাসের ভেতর থেকে কেউ মজা করে।
কালীপদ হাসে। মনে মনে বলে, হ্যাঁ, স্বপ্নই বটে। কালীপদর মনে হয় তাকে এখন দশজন দেখুক। দেহের শক্তির তুলনায় জিনিসপত্রগুলো একটু ভারী। তুলির দুটো ফ্রক, স্কুল ড্রেস, স্কুলব্যাগ, পাউডার, ক্রিম, পেন, খাতা, আপেল, কমলালেবু সব প্যাকেটে করে নিয়ে এসেছে। তুলির অনেকদিনের চাওয়াগুলো মনে করে করে কিনেছে আর মনে মনে বলেছে, ‘তোর জন্যেই তো সব, তুই ছাড়া কে আমার আছে?’
বাড়িতে ঢুকতে যাওয়ার আগে গলির মোড়ে প্রতিবেশী মহিলার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় কালীপদর।
— ‘তুলি ঘুম থেকে উঠেছে বৌমা?’
— ‘অনেকক্ষণ, আপনাকে না দেখে ভীষণ ব্যস্ত হয়েছে। এত দেরি লাগল আপনার?’
— ‘অনেক কিছু কিনতে হল। ওর জামা, স্কুলব্যাগ, স্কুলড্রেস, পাউডার, ক্রিম, ওর ফল, কমলালেবু, আপেল…’ কালীপদ গর্বের সঙ্গে বলতে থাকে।
প্রতিবেশী মহিলা সে কথায় সাড়া না দিয়ে বলে, ‘ডাক্তার এসেছে, তুলিকে দেখছে।’ বলেই এগিয়ে চলে যায়।
কালীপদ বলার চেষ্টা করে, কেমন আছে তুলি। বলতে পারে না। মন্থর পায়ে কালীপদ বাড়ির দরজা পর্যন্ত এগিয়ে আসে।
বাড়ির দরজা খোলা। বিছানায় তুলি বসে আছে ডাক্তারের মুখোমুখি। তুলি উজ্জ্বল মুখে গল্প করছে ডাক্তারের সঙ্গে, ডাক্তার হাসছে। কালীপদ বাড়ির দরজায় দু’হাতে অনেকগুলো প্যাকেট নিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে— যেন দুটো পাখি পাতার ছায়ায় বসে গল্প করছে— আর এক পা এগোলে ওরা উড়ে যাবে।
শনিবারের চিঠি, মার্চ, ২০১৩
অঙ্কনঃ ডি’সুজা